
টিসিবির ৫১ কার্ডসহ পণ্য বিক্রি জামায়াত নেতার দোকানে
দারিদ্র্য বিমোচনের সরকারি উদ্যোগে ভয়াবহ জামায়াত নেতার, ক্ষোভে ফুঁসছে, তদন্তের দাবি এলাকাবাসীর
সরকারের দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম উদ্যোগ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর পণ্য বিতরণে চাঞ্চল্যকর অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার লক্ষীপুর ইউনিয়নে। জনগণের জন্য বরাদ্দ এই ত্রাণ-সদৃশ সহায়তা এখন যেন পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় এমন অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা।
ফলিয়া এলাকার ৯নং ওয়ার্ডে এক দোকানেই ৫১টি স্মার্ট কার্ডের পণ্য বিক্রয় চলছিল বলে জানা গেছে। আর সেই দোকানটি কোনো সাধারণ ব্যবসায়ীর নয় সেটি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী লক্ষীপুর ইউনিট সভাপতি ও বাইতুলমাল সহ-সম্পাদক আনোয়ার হোসেনের মালিকানাধীন।
গত ১ সেপ্টেম্বর, শনিবার, সকালে আনোয়ার হোসেনের দোকানে অস্বাভাবিক ভিড় লক্ষ্য করেন স্থানীয়রা। টিসিবির পণ্য ৫ কেজি চাল, ২ লিটার তেল, ১ কেজি চিনি ও ১ কেজি মসুর ডাল বিতরণের নামে দোকানে উপকারভোগীদের ভিড় জমে।
কৌতূহলবশত কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। তারা দেখতে পান, দোকানে একসাথে ৫১টি স্মার্ট কার্ডের পণ্য বিক্রয়ের কাজ চলছে!
এমন দৃশ্য ধরা পড়তেই এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে চাঞ্চল্য। অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, টিসিবির পণ্য গরিব মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা, অথচ জামায়াতের নেতারা এখন সেটি নিজেদের দোকানে বিক্রি করে মুনাফা করছে!
টিসিবির স্মার্ট কার্ড চালুর মূল লক্ষ্য ছিল অনিয়ম বন্ধ করা, একই পরিবারের একাধিক সদস্যের কার্ড রোধ করা এবং বিতরণ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা। কিন্তু যখন একজন রাজনৈতিক নেতা ও খুচরা ব্যবসায়ীর হাতে একসাথে ৫১টি কার্ডের পণ্য আসে, তখন পুরো ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাই প্রশ্নের মুখে পড়ে।
স্থানীয়দের প্রশ্ন, একজন ব্যক্তির দোকানে এতগুলো কার্ডের পণ্য কীভাবে পৌঁছাল? তিনি কি টিসিবির কোনো অনুমোদিত ডিলার? না কি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সরকারী সহায়তা নিজের নিয়ন্ত্রণে এনেছেন?
সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে নিজেকে জামায়াতের ইউনিট সভাপতি ও বাইতুলমাল সহ-সম্পাদক হিসেবে স্বীকার করেছেন আনোয়ার হোসেন। তাঁর দোকানে সরকারি পণ্য বিক্রয়ের এমন ঘটনা প্রকাশ পাওয়ায় অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, একজন জামায়াত নেতা কতটা প্রভাবশালী হলে টিসিবির মতো সরকারি প্রকল্পের পণ্য নিজের দোকানে এনে বিক্রি করতে পারে? এ ক্ষমতার উৎস কোথায়?
এলাকাবাসীর দাবি, এটি কোনো একক ঘটনা নয়; বরং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিয়মিতভাবে এমন অপব্যবহার করছে।
সরকারের এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল নির্দিষ্ট নিম্নআয়ের মানুষকে সহায়তা দেওয়া। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অনেক প্রকৃত দরিদ্র এখনো কার্ড পাননি, অথচ প্রভাবশালীরা একের পর এক কার্ডের মালিক।
স্থানীয় এক প্রবীণ নাগরিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এ যেন গরিবের হক লুটে নেওয়ার উৎসব চলছে। জামায়াত নেতার দোকানে সরকারি পণ্য বিক্রি হতে দেখলে বোঝা যায় নীতির কথা বললেও লোভের কাছে পরাজিত তারাই।
ফলিয়া এলাকার স্থানীয়রা বলেন, এভাবে সরকারের সহায়তা প্রকল্প রাজনৈতিক নেতাদের হাতে পড়লে টিসিবির প্রতি জনগণের আস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে।
যেখানে জামায়াতের নেতারা সরকারের খাদ্য সহায়তা প্রকল্পের পণ্য পর্যন্ত নিজেদের দোকানে বিক্রি করেন, সেখানে ন্যায়ের কথা বলার মুখ তাদের নেই এমন মন্তব্য করেছেন স্থানীয় শিক্ষক সমাজের এক সদস্য।
এক সময় ধর্মীয় স্লোগান আর নৈতিকতার কথা বলে জনমনে অবস্থান তৈরি করেছিল জামায়াত ইসলামি। কিন্তু আজ তাদের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতার দোকানে সরকারি ত্রাণসদৃশ পণ্য বিক্রয়ের দৃশ্য যেন বলে দিচ্ছে ধর্মের ছদ্মবেশে ব্যবসা আর সুবিধা লুটে নেওয়াই এখন তাদের নীতি।
টিসিবি পণ্য বিতরণে নতুন করে দেখা দিয়েছে রহস্যজনক জটিলতা ও অনিয়মের অভিযোগ। টিসিবির ন্যায্য মূল্যের পণ্য কারা, কীভাবে বিতরণ করছে এ নিয়েই চলছে তোলপাড়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইউনিয়নের ফলিয়া এলাকার এক দোকানে একযোগে ৫১টি স্মার্ট কার্ডের পণ্য বিক্রির ঘটনায় এলাকাজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে পুরনো ডিলার শামসুল আলম সংবাদমাধ্যমকে জানান, আমি আগে ডিলার ছিলাম, কিন্তু গত দুই মাস ধরে আমি আর ডিলার নাই। গতকাল শনিবার আমি কোনো টিসিবির পণ্য দেই নাই, নতুন ডিলারই মাল দিচ্ছে।
এদিকে নতুন ডিলার হিসেবে নাম উঠে এসেছে আটঘরিয়া উপজেলার যুবলীগ নেতা পান্নার। বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা কোনো দুর্নীতি বা অনিয়ম করেছি কি না, সেটা তদন্ত করে দেখা যেতে পারে। তবে অন্য কোনো বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলুন।
স্থানীয়দের অভিযোগ নতুন ডিলার নিযুক্তির বিষয়টি নিয়ে কোনো সরকারি ঘোষণা হয়নি, অথচ হঠাৎই এক যুবলীগ নেতার দোকান থেকে টিসিবির পণ্য বিক্রি শুরু হয়। এতে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছে সরকারি ন্যায্য মূল্য কর্মসূচির আড়ালে কি গোপনে চলছে রাজনৈতিক প্রভাব ও পণ্য বাণিজ্য?
আটঘরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিনহাজুল ইসলাম বলেন, একজন ব্যক্তির কাছে এতগুলো কার্ড থাকার কথা না একটা-দুইটা নয়, পুরো ৫১টা কার্ড! ওই ব্যক্তির বিস্তারিত নাম ঠিকানা দিন। ট্যাগ অফিসার কীভাবে এটা দেখলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডিলারদের বলা থাকে, যখন পণ্য বিতরণ করবে তখন যেন ট্যাগ অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
তদারকি করার জন্য কেউ যায় কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ইউএনও বলেন, আমাদের নির্দেশনা আছে ট্যাগ অফিসারদের যেতে হয়। যদি কোনো কারণে নিজে যেতে না পারেন, তাহলে অফিসের কাউকে পাঠানোর নিয়ম আছে।
তিনি আরও বলেন, আপনি ওই ব্যক্তির নাম-ঠিকানা দিন, আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখব।
এলাকাবাসী দাবি তুলেছেন, এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হোক, দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক যেন গরিবের হক আর কেউ এমনভাবে বিক্রি করতে না পারে।