
পিটার হাসের সফরের পরই উত্তপ্ত পরিস্থিতি, এবার কি টার্গেট কক্সবাজারসা সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের কক্সবাজার সফরকে ঘিরে নতুন করে রাজনৈতিক উত্তেজনা ছড়িয়েছে। গত মাসে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের সঙ্গে তাঁর গোপন বৈঠকের গুঞ্জনের রেশ কাটতে না কাটতেই বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫) তিনি হঠাৎ কক্সবাজারে হাজির। আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই মহেশখালীর ‘এক্সিলারেট হোপ হসপিটাল’ পরিদর্শনের নামে এই সফর নিয়ে স্থানীয় ও রাজনৈতিক মহলে উঠেছে নানা প্রশ্ন। অনেকে মনে করছেন, এই সফর কি শুধুই হাসপাতাল পরিদর্শন, নাকি পর্দার আড়ালে চলছে বৃহত্তর কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা?
মহেশখালীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ জানান, পিটার হাস হোপ ফাউন্ডেশন ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জ্বালানি কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হাসপাতাল পরিদর্শনে গেছেন। হোপ ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি ডিরেক্টর কে এম জাহিদুজ্জামান বলেন, “এটি পূর্বপরিকল্পিত কোনো সফর ছিল না। পিটার হাস হঠাৎ এসেছেন, কোনো আনুষ্ঠানিক আয়োজন ছাড়া।” তবে এই ‘অপরিকল্পিত’ সফরের সময় ও পটভূমি নিয়ে সন্দেহের কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। এনসিপি নেতাদের সঙ্গে পূর্বের গুঞ্জন এবং বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে অনেকে মনে করছেন, কক্সবাজার কি এবার কোনো বড় রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু হতে যাচ্ছে?
এসব কথায় স্পষ্ট যে আসলে এই উদ্দেশে এবার কক্সবাজার আসেননি সাবেক মার্কিন এই রাষ্ট্রদূত। পিটার হাসের সফরের পরই কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর তীরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হয়েছে। এ অভিযান বন্ধের দাবিতে শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) কয়েক শ নারী-পুরুষ শহরের প্রধান সড়কে নেমে বিক্ষোভ করেছেন। কয়েকটি স্থানে টায়ার জ্বালিয়ে, ঠেলাগাড়ি রেখে ও গাছের গুঁড়ি ফেলে প্রায় দুই ঘণ্টা সড়কটি অবরোধ করে রাখা হয়। বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের বাধার মুখে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি।
সূত্র বলছে, সেন্ট মার্টিনের পর এবার কক্সবাজার নিয়ন্ত্রণে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে আমেরিকা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের মহেশখালী সফর এবং একই দিনে মহেশখালী-মাতারবাড়ি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মন্তব্যকে কেন্দ্র করে তীব্র উদ্বেগ ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
আমিনুল ইসলাম নামের এক ভেরিফায়েড ফেসবুক ব্যবহারকারী তার ব্যক্তিগত প্রোফাইলে একটি পোস্টের মাধ্যমে এই দুটি ঘটনাকে পাশাপাশি রেখে দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। পোস্টটি প্রকাশের পরপরই সামাজিক মাধ্যমে এটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়।
তার পোস্টে আমিনুল ইসলাম লিখেছেন, "আজকে দেখলাম পিটার হাস মহেশখালীতে গেছে। আর আজই অধ্যাপক ইউনূস এই কথা এই কথা বলেছেন! বাংলাদেশ কি থাকবে নাকি আস্ত দেশটাই দিয়ে দিবেন? ইউনূস দেশ বিক্রি করতে আসছে।"
তিনি তার পোস্টে আরও যোগ করেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশে প্রবেশ করেছে, সেসব দেশের পরিস্থিতি ভালো নয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি সিরিয়া, আফগানিস্তান, সুদান ও ইরাকের কথা উল্লেখ করেন এবং আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশেও তেমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
তার এই পোস্টের সাথে তিনি দৈনিক সমকালের একটি প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট যুক্ত করেন। ওই প্রতিবেদনে প্রধান উপদেষ্টার বরাত দিয়ে শিরোনাম করা হয়েছে, "মহেশখালী-মাতারবাড়িতে নতুন শহরের জন্ম হবে: প্রধান উপদেষ্টা"। প্রতিবেদনের ভেতরের অংশে আরও লেখা ছিল, "প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আমরা সমুদ্র জগতে কখনো প্রবেশ করিনি। ওটা নিয়ে চিন্তাও করিনি।"
বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারে চীন-সমর্থিত গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কৌশলগত অবস্থান নিতে সক্রিয় হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট, মানবিক করিডোর, এবং চট্টগ্রাম বন্দর, সেন্টমার্টিন্সে নৌঘাঁটি—সব মিলে এই অঞ্চলটি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে একটি “খ্রিস্টান রাজ্য” গঠনের ষড়যন্ত্রের আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন অনেকে, যা পূর্ব তিমুরের ঘটনার সাথে তুলনা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আগেও সতর্ক করে বলেছিলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের কিছু অংশ নিয়ে এমন একটি রাষ্ট্র গঠনের ষড়যন্ত্র চলছে এবং এ সংক্রান্ত প্রস্তাবনা বাংলাদেশে একটি এয়ার বেজ স্থাপনের মাধ্যমেও এসেছে।
একাধিক সূত্র ও বিশ্লেষকের মতে, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে এই ষড়যন্ত্রে “প্রক্সি নেতা” হিসেবে ব্যবহার করছে মার্কিন প্রশাসন। তাদের দাবি, ইউনূসকে জাতিসংঘ মহাসচিব করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের সহায়তা, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পে বাধা এবং বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির মতো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
২০২২ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন পিটার হাস। এক বছর আগে কূটনৈতিক পেশা থেকে অবসরে যাওয়ার পর এখন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জ্বালানি কোম্পানি ‘এক্সিলারেট এনার্জি’র স্ট্র্যাটেজিক অ্যাডভাইজর হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
বাংলাদেশে ‘এক্সিলারেট এনার্জি’র ব্যবসা থাকায় মাঝেমধ্যে আসতে হয় পিটার হাসকে। গত ৫ অগাস্ট জুলাই অভ্যুত্থানের বার্ষিকীর দিন কক্সবাজারে তিনি এনসিপির পাঁচ শীর্ষ নেতার সঙ্গে ‘গোপন বৈঠক’ করছেন বলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছিল।
বিশ্লেষকদের মতে, উন্নয়ন পরিকল্পনা বা বিদেশি কূটনৈতিক তৎপরতার আড়ালে বাংলাদেশকে মার্কিনি স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের মতে, এই মুহূর্তে একটি গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে দেশের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে পারে।